একতরফা প্রেম—একটি অনুভূতি যা আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়, আমাদের জীবনের গভীরতম অনুভূতিগুলোর একটিকে স্পর্শ করে। কিন্তু যখন এই প্রেম একতরফা হয়, তখন তা আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করতে পারে। সনাতন ধর্মের দর্শন আমাদের এই অবস্থার মোকাবিলা করতে দিশা দেয়। আমি এই লেখায় সনাতন ধর্মের শিক্ষার আলোকে একতরফা প্রেমের বিষয়টি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব।
প্রেমের প্রকৃতি: সনাতন ধর্মের দৃষ্টিকোণ
প্রথমেই, সনাতন ধর্মে প্রেমকে এক উচ্চতর আধ্যাত্মিক শক্তি হিসেবে দেখা হয়। যেমন ভগবদ্গীতা ১২.১৩-১৪ শ্লোকে উল্লেখ করা হয়েছে:
“অদ্বেষ্ঠা সর্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ ঐব চ।”
অর্থাৎ, একজন প্রকৃত ভক্তের মধ্যে কারো প্রতি বিদ্বেষ থাকে না, সকলের প্রতি তিনি সদয় ও করুণাময় হন।
তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো, সনাতন ধর্ম তোমাকে শিক্ষা দেয় যে সেই ভালোবাসা নিঃস্বার্থ হওয়া উচিত। কিন্তু একতরফা প্রেমে যখন প্রত্যাশার পাল্লা ভারী হয়, তখন তা দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একতরফা প্রেমের মানসিক ভারসাম্য
একতরফা প্রেমে আমরা প্রায়ই আমাদের সুখ-দুঃখের ভার অন্য কারো হাতে দিয়ে দিই। অথচ, “গীতা”র দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে:
“সমত্বং যোগ উচ্যতে।”
অর্থাৎ, জীবনের প্রতিটি অবস্থার মধ্যে সমানভাবে থাকার ক্ষমতা অর্জন করাই যোগ। তুমি যদি একতরফা প্রেমে ভেঙে পড়ো, তবে এই শিক্ষাটি তোমার মানসিক শান্তি রক্ষায় সাহায্য করবে।
একতরফা প্রেমে ঈশ্বরের অভিমুখী হওয়া
একটি সত্য ঘটনা মনে করো—মীরা বাঈয়ের জীবন। মীরা শ্রীকৃষ্ণকে তার স্বামী ও প্রভু রূপে মেনে নেন, যদিও শ্রীকৃষ্ণ শারীরিকভাবে কখনো তার কাছে ছিলেন না। তার প্রেম ছিল একতরফা, কিন্তু সেই প্রেম তাকে ঈশ্বরের আরও কাছে নিয়ে গিয়েছিল। মীরার মতো, তুমি যদি তোমার প্রেমকে আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত করো, তবে তা তোমার জন্য দুঃখ নয়, বরং শান্তির উৎস হবে।
একতরফা প্রেমে করণীয়
সনাতন ধর্মে আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে প্রত্যাশা কমাতে হবে এবং নিজের আত্মাকে চিনতে হবে।
- ধ্যান ও যোগ চর্চা: ভগবদ্গীতার ৬.৫ শ্লোকে বলা হয়েছে, “উদ্ধরেদ আত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েত।” নিজেকে নিজেই উন্নত করতে হবে।
- কর্মযোগে মনোযোগ: যদি তুমি কারো প্রতি একতরফা প্রেমে পড়ে থাকো, তবে নিজের মনকে কর্মে নিবিষ্ট করো। কর্মযোগের মাধ্যমে তুমি তোমার মানসিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে পারবে।
- ঈশ্বরের প্রতি প্রেম: ঈশ্বরকে ভালোবাসা সব প্রেমের সর্বোচ্চ রূপ। একতরফা প্রেমের যন্ত্রণা ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ করলে শান্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
প্রতিদিনের জীবনে এই শিক্ষাগুলো প্রয়োগ করা
আমার নিজের জীবনে, একবার একতরফা প্রেমের অভিজ্ঞতা হয়েছিল। আমি অনুভব করেছিলাম, এই প্রেম আমাকে মানসিকভাবে দূর্বল করে তুলছে। তখন আমি ধ্যান শুরু করলাম এবং ঈশ্বরের প্রতি সমর্পণ করলাম। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম, প্রেম নিজে থেকে নয়, প্রত্যাশার ভারই আমাকে কষ্ট দিচ্ছিল।
প্রেমের মুক্তি
প্রেমকে মুক্তি দিতে শিখো। “যত ভালবাসা তত মুক্তি”—এই শিক্ষাই সনাতন ধর্ম আমাদের দেয়। যদি তুমি কাউকে ভালোবাসো, তবে তাদের মুক্তি দাও এবং তোমার নিজের মনকে মুক্ত রাখো। যেমন উপনিষদে বলা হয়েছে:
“সত্যমেব জয়তে।”
যে প্রেম সত্য, তা নিজেই টিকে থাকবে; যে প্রেম অসত্য, তা তোমার জীবনের শান্তি কেড়ে নেবে না।
উপসংহার
তোমার জীবনে একতরফা প্রেম যদি আসে, তবে তা আধ্যাত্মিক শিক্ষার এক বড় সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করো। সনাতন ধর্মের শিক্ষার আলোয় নিজের পথ খুঁজে নাও। আর ভেবে দেখো, প্রেম আসলে ঈশ্বরের একটি রূপ—তাহলে কি তা কখনো একতরফা হতে পারে?